রবিবার ব্রেকফাস্ট টেবিলে, টোস্টে মাখন মাখাতে - মাখাতে মালতী বলল, "বৌদি আগামী দু-তিন মাস, আমি শনি-রবিবার কাজে আসতে পারব না গো!" অমৃতা আঁতকে উঠে বলে, "সে কী, আসতে পারবে না মানে? তুমি তো জানো উইকএন্ডে আমার কত কাজের চাপ থাকে। সারা সপ্তাহ অফিস করেই দুটো দিনই তো পাই ,বাড়ির কাজ সামলানোর জন্য। কী অসুবিধা তোমার?"
"এখন থেকে আমার স্বামীকে শনি-রবিবার ও কাজে যেতে হবে। ছেলেটা একা থাকলে কোনো কথা শোনে না। সারাদিন বাইরে খেলে বেড়ায়।"
অমৃতা তখন বলল, "একটা কাজ কর, তোমার ছেলে ― কী যেন নামটা?"
"আজ্ঞে বৌদি, অমল।"
"হ্যাঁ, অমল। ওকেও সঙ্গে করে নিয়ে এসো, ও এখানেই পড়াশোনা করবে তারপরে বিকেলে তোমার সাথে বাড়ি চলে যাবে।"
"তাহলে তো খুব ভালো হয় বৌদি, আমার আর কোনো চিন্তা থাকে না"
টুবুল, যার ভালো নাম ময়ূখ, সে মন দিয়ে দুজনের কথা শুনছিল আর সানি সাইড আপ ডিমের পোচ, খাচ্ছিল। একজন নতুন বন্ধু হবে জানতে পেরে সে খুব খুশি হয়ে উঠলো। ভাবল, সামনেই ক্রিসমাসের ছুটি- ভালোই হবে, দুজনে মিলে বেশ খেলা যাবে। এরপর অমল যেদিন টুবুলদের বাড়ি এলো, ঘন্টা খানেকের মধ্যেই দুজনের খুব ভাব হয়ে গেল।
পড়াশোনা হয়ে গেলে ওরা ছাদে খেলতে চলে গেল। অমল একটা সরকারি স্কুলের ক্লাস টু এর ছাত্র আর টুবুল, একটা ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে ক্লাস থ্রির ছাত্র । টুবুলের বাবার,বাংলার বাইরে বাইরে সবসময় কাজ। সেই জন্য টুবুল বাংলা লিখতে- পড়তে পারেনা। বছর দুয়েক হল টুবুলের বাবা কলকাতায় বদলি হয়ে এসেছেন। টুবুল কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। ইংলিশ ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ ও হিন্দি সেকেন্ড ল্যাংগুয়েজ। টুবুলের আত্মীয়-স্বজনরা ওকে অনেক বাংলা বই উপহার দিয়ে বলেছেন, "এবারে বাংলাটা শিখে নাও।" কিন্তু কিছুতেই আর সেটা হয়ে উঠে না। মা-বাবা ব্যস্ত থাকেন আর টুবুলেরও পড়ার খুব চাপ।
অনেকক্ষণ খেলারর পর দুই বন্ধু ক্লান্ত হয়ে ছায়ায় বসে গল্প করতে লাগল। অমল বলল, "আচ্ছা টুবুলদা, তুমি তো ইংরেজি স্কুলে পড়ো। আমায় কয়েকটা ইংরেজি কবিতা শিখিয়ে দেবে?" টুবুল বিজ্ঞের মত মাথা নেড়ে বললো, "দিতে পারি কিন্তু একটা শর্তে! "
"কী শর্ত?"
"আমাকেও বাংলা কবিতা শেখাতে হবে।"
"এই কথা! সে তো খুব সোজা!"অমল বলে। "আমি পরের সপ্তাহে ,'বর্ণপরিচয়' নিয়ে আসব। " পুরো সপ্তাহটা টুবুলের খুব উত্তেজনায় কাটল।
শনিবার অমল আসতেই দুজনের চোখে-চোখে কথা হয়ে গেল। পড়াশোনা শেষ করেই দুই বন্ধু ছাদে চলে গেল।
"আগে বর্ণপরিচয় শেখো, তারপরে সহজ পাঠ।"
দেখা গেল অমল ছাত্র এবং শিক্ষক দুই হিসেবেই খুব ভালো। সে তাড়াতাড়ি ইংরেজি শিখে গেল এবং খুব তাড়াতাড়ি টুবুলকে বাংলা অক্ষর মালা শিখিয়ে দিল। টুবুল মেধাবী ছাত্র। ক্লাসে প্রথম পাঁচজনের মধ্যে থাকে।
দুজনের মধ্যে একটা চুক্তি হলো যে কেউই বাড়ির কাউকে কিছু বলবে না, হঠাৎ করে একদিন চমকে দেবে। টুবুল অমলকে নার্সারি রাইম শেখায়, 'টুইংকেল- টুইংকেল, লিটল স্টার', 'হাম্পটি- ডামটি', আর অমল টুবুলকে শেখায়, 'কাল ছিল ডাল খালি, আজ ফুলে যায় ভরে', কিম্বা 'কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি'।
ফেব্রুয়ারি মাসে পাড়ায় সরস্বতী পুজো। সন্ধ্যেবেলায ফাংশন। টুবুল ঠিক করলো, সেদিন ফাংশনে একটা কবিতা বলে সবাইকে চমকে দেবে। অমলও একটা কবিতা বলবে। অমৃতা ও বরুণ (টুবুলের বাবা) দুজনেই খুব নিশ্চিন্ত এখন। ছুটির দিনে,আগে টুবুল খুব বিরক্ত করত, বেড়াতে যাওয়ার বায়না করত। এখন ও বেশ শান্ত হয়ে গেছে, কী সব যেন মুখস্থ করে সব সময় ― ওরা কাছে গেলেই চুপ করে যায়।
দেখতে দেখতে সরস্বতী পুজো এসে গেল। টুবুল আর অমল, দুজনে চুপি-চুপি ক্লাবে গিয়ে নাম লিখিয়ে এলো, সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের যোগদানের জন্য। বিকেল বেলায় টুবুল মা-বাবাকে জোরাজুরি করতে লাগল,
"চলো না, চলো না- পাড়ার ফাংশন দেখতে যাব।" অগত্যা ওরা দুজন তৈরি হয়ে ছেলেকে সাথে নিয়ে ফাংশনে গিয়ে বসলেন।অমলও এসেছে ওর মার সাথে। সুন্দর অনুষ্ঠান হচ্ছে, পাড়ার ছোটো ছোটো বাচ্চারাই সব নাচ-গান করছে। হঠাৎ মাইকে ঘোষণা হলো, 'এখন আপনাদের পরপর দুটি কবিতা বলে শোনাবে, অমল হালদার ও ময়ূখ চৌধুরি।'
অমৃতা ও বরুণ তো হতবাক! কবিতা বলবে, টুবুল! অমল ও ময়ূখ ততক্ষণে স্টেজে। প্রথমে অমল শুরু করল, 'তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে !' বেশ সুন্দর করে কবিতাটি বলল অমল। এরপরে ময়ূখ মাইক নিয়ে শুরু করল বলা,
'একদিন রাতে আমি স্বপ্ন দেখিনু,
চেয়ে দেখো- চেয়ে দেখো বলে যেন বিনু! ' পরিষ্কার উচ্চারণ ― কোথাও কোনো অসুবিধা নেই। অমৃতা ও বরুণ অবাক! কোথায় শিখল? কার কাছে?
স্টেজ থেকে নামতেই ময়ূখকে জড়িয়ে ধরল মা-বাবা! "কোথায় শিখলি রে?" ময়ূখ উজ্জ্বল মুখে বলে, "অমল শিখিয়েছে।"
"অমল! তাই নাকি? কোথায় অমল, কোথায়?" অমলকে জড়িয়ে ধরে অনেক আদর করে, অমৃতা ও বরুণ। বলেন, "যেটা আমাদের করার কথা ছিল, আমরা তো করতে পারিনি। তুই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলি যে মাতৃভাষা শিখতে কোনো কষ্ট নেই। এটা প্রাণের ভাষা, আনন্দের ভাষা। ইচ্ছে থাকলেই শেখা যায় শুধু উদ্যোগের প্রয়োজন।"
-অনুরাধা দেব